১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হয় মুক্তিযু্দ্ধ এবং ঐ বছর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। এই মুক্তিযুদ্ধ মুলত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্য ও দাবিয়ে রেখে শোষণ করা থেকে মুক্ত হওয়ার প্রবল ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সামাজিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক,ধর্মীয়সহ সকল ধরনের বৈষম্য প্রকটভাবে করতে থাকে ।
১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এবং আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনিই হন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখাগরিষ্ঠ দলের নেতা। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব সংখাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, তাতেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নিকট তাঁর মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ইতোমধ্যে সমস্যা নিরসনের জন্য শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা ব্যর্থ হয় এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙালি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সৈন্য এবং আধা সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা তাৎক্ষণিকভাবে জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের উপর অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক ঐ পরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি সদরদপ্তর স্থাপন করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে প্রথম সদরদপ্তরটি গঠিত হয়। এখানে ৫৭তম বিগ্রেডের বিগ্রেডিয়ার আরবাবকে শুধু ঢাকা নগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় এবং মেজর জেনারেল খাদিম রাজাকে প্রদেশের অবশিষ্টাংশে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্বে থাকেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান।
২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ওয়ারলেস বসানো জিপ ও ট্রাকে করে ঢাকার রাস্তায় নেমে পড়ে। তাদের প্রথম সাঁজোয়া বহরটি ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এক কিলোমিটারের মধ্যে ফার্মগেট এলাকায় ব্যরিকেডের মুখে পড়ে। রাস্তার এপাশ-ওপাশ জুড়ে ফেলে রাখা হয়েছিল বিশালাকৃতির গাছের গুঁড়ি।কয়েকশ লোক প্রায় ১৫ মিনিট ধরে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়। তবে সেনাদের গুলি দ্রুতই তাদের নিস্তদ্ধ করে দেয়, সেনাবহর শহরময় ছড়িয়ে শুরু করে গণহ
পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায়-ফুটপাতে যাকেই দেখতে পায় তাকেই হত্যা করে, সামনে পড়া সবকিছু ধ্বংসের হুমকি দেয়। বাছবিচার না করে শহরের মানুষ ও সরকারি-বেসরকারি সব ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত করে চষে বেড়ায় সৈন্যদের ট্যাঙ্ক। কামান ও বন্দুকের গোলায় ধ্বংস করে বহু আবাসিক এলাকা, আগুন ধরিয়ে দেয় বাড়িঘরে। সৈন্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ঢুকে অনেক ছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককেও ঐ রাতে হত্যা করে। পুরনো ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তারা হামলা চালায়, অসংখ্য মানুষ হত্যা করে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় ও লুটপাট করে, মহিলাদের ধর্ষণ করে।
নিরস্ত্র জনগণের উপর এই হামলা ও নির্বিচার গণহত্যা অভিযান বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়। ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সকল এলাকায় সকল শ্রেণী পেশার মানুষ স্বাধীনতার জন্য স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান গড়ে তোলে। । পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা মোকাবেলার জন্য গড়ে তোলে। শত্রু সেনারা সংখ্যায় অনেক ও তারা ছিল অনেক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, তাই মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যায়। শীঘ্রই দেশের বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্ন মুক্তিসংগ্রামীদের একটি একক কমান্ডের অধীনে আনা হয়।
এপ্রিল মাসের ৪ তারিখে মুক্তিবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চা বাগানে পরিবৃত আধা-পাহাড়ি এলাকা তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সদরদপ্তরে একত্রিত হন।এ সভায় চারজন সিনিয়র কমান্ডারকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর সফিউল্লাহকে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া অঞ্চলের অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়। কুমিল্লা-নোয়াখালি অঞ্চলের অধিনায়কের দায়িত্ব পান মেজর খালেদ মোশাররফ। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমান এবং কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলের অধিনায়ক হন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। এ সভাতেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনী সম্পর্কিত সাংগঠনিক ধারণা এবং কমান্ড কাঠামোর রূপরেখা প্রণীত হয়। কর্নেল এম.এ.জি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বময় নেতৃত্ব দেয়া হয়।
১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তথা মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। পরদিনই তাজউদ্দিন আহমদ আরও তিনজন আঞ্চলিক অধিনায়কের নাম ঘোষণা করেন। ১০ থেকে ১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের এক সম্মেলনে অপারেশন চালানোর সুবিধার্থে সমগ্র বাংলাদেশকে এগারোটি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ মার্চ বাঙালিদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তাঁর সরকারের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং সার্বিক সহযোগিতা দিতে শুরু করেন।
ভারতে শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হয়। এ শিবিরগুলো থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হতো। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিভিন্ন সেক্টরে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত করা হয়। কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ বাহিনীর সদরদপ্তর স্থাপিত হয়।
পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি আরও অনেক বাহিনী সংগঠিত হয়। এ সকল বাহিনীর মধ্যে টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনী, সিরাজগঞ্জের লতিফ মির্জা বাহিনী, ঝিনাইদহের আকবর হোসেন বাহিনী, ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী, বরিশালের কুদ্দুস মোল্লা বাহিনী ও গফুর বাহিনী এবং ময়মনসিংহের আফসার বাহিনী ও আফতাব বাহিনী উল্লেখযোগ্য। এ সকল বাহিনী স্থানীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে নিজেদের শক্তিতে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। ভারতের সেনাবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল ওবানের সক্রিয় সহযোগিতায় মুজিব বাহিনী নামে আরেকটি বাহিনী গঠিত হয়। মুজিববাহিনীর সদস্যদের দেরাদুনে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক এবং সিরাজুল আলম খান ছিলেন এই বাহিনীর সংগঠক।
আরো পড়ুন:
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই ওয়েবসাইটের কোনো কনটেন্ট অন্য কোন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ইতিমধ্যে থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। কেউ এই ওয়েবসাইটের কনটেন্ট কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দিলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।