প্রবাদ – প্রবচন তৈরির প্রধান কারণ হিসেবে বলা যায় জীবনের কোনও জরুরি অভিজ্ঞতার কথা খুব সহজে, ছোট করে কম কথাতে মজাদার ভাবে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া।
প্রবাদ – প্রবচন সবাই সহজেই বুঝতে পারে, বলতে পারে। এর মধ্যে জটিল কথা নেই। শুনলেই মনে থাকে। ছন্দ, অন্ত্যমিল ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর ভাবে অভিজ্ঞতা, নীতিকথা, সমালোচনা, রাজনীতি বা কোনো বিখ্যাত ঘটনার নজির তুলে ধরা হয় প্রবাদ প্রবচনের মাধ্যমে ।
আরবি, ফারসি, ইংরেজি, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা থেকেও প্রবাদ – প্রবচনগুলো নেওয়া হয়েছে। প্রবাদের উৎপত্তির পিছনে কিছু কারণ বা চলতি গল্প থাকে । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গল্প বা কারণগুলো মুছে গেলেও প্রবাদের ভিতরকার অর্থের জন্য সেগুলো ব্যবহার করা হতে থাকে ।
বাংলা ভাষার অগাধ প্রবাদ-সমুদ্র থেকে তুলে ধরা হল কিছু মণিমুক্তো |
১) দশচক্রে ভগবান ভূত।
চলতি গল্প – একজন লোকের নাম ছিল ভগবান। সে রাজার আশ্রয় পেয়ে বেড়ে উঠেছিল। সুবিধাবাদী লোকজনেরা ভগবানের সৌভাগ্য সহ্য করতে পারত না।
তাই তারা ষড়যন্ত্র করে রটিয়ে দিল ভগবান মারা গেছে। কিন্তু রাজা একদিন ভগবানের গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি সন্দেহ করলেন যে হয়ত ভগবান বেঁচে আছে। কিন্তু সুবিধাবাদীরা বোকা রাজাকে বোঝালো মৃত ভগবানের আত্মা ভূত হয়ে ফিরে এসেছে। সুবিধাবাদীদের সবার মুখে একই কথা শুনে বোকা রাজা তাদের কথাতেই বিশ্বাস করলেন।
অর্থ – দুষ্ট লোকের পাল্লায় পড়লে শিষ্টেরও অনিষ্ট হয় বা দশজনের কথায় মিথ্যেকেও সত্যি বলে মনে হতে পারে ।
২) বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?
চলতি গল্প – একটা বিড়াল ইঁদুর মেরে খেয়ে নিচ্ছিল। বিড়ালের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ইঁদুররা ঠিক করল যদি বিড়ালের গলায় একটা ঘন্টা বেঁধে দেওয়া যায় তাহলে বিড়াল কাছে এলেই ঘন্টার শব্দে সতর্ক হওয়া যাবে। কিন্তু একজন বুড়ো ইঁদুর প্রশ্ন করল, বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? কারণ যে ইঁদুর বিড়ালের কাছে যাবে বিড়াল তাকেই মেরে খেয়ে ফেলবে।
অর্থ – কথায় সাহস দেখালেও কাজের সময় সাহস দেখাতে পারা সহজ নয়।
৩) বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর।
চলতি গল্প – এক বামুন বা বাহ্মণ কিছু লোকজনকে দিয়ে জমিতে চাষ করাত । বামুন যতক্ষণ কাজের দিকে নজর রাখত ততক্ষণ লোকজন ঠিক করে কাজ করত । কিন্তু বামুনের নজর অন্যদিকে গেলেই তারা কাজে গাফিলতি করত।
অর্থ – কাজের দিকে নজর না দিলে কাজ ভাল হয় না।
৪) হাতি ঘোড়া গেল তল
মশা বলে কত জল।
চলতি গল্প – এক জায়গায় অনেকখানি গভীর জল ছিল। হাতি, ঘোড়া সকলেই সেই জল পার হতে গিয়ে ডুবে যাবার উপক্রম। কিন্তু আকারে সামান্য যে মশা, সে নিজের বড়াই করতে হাতি ঘোড়াকে বলে এ আর এমনকি জল যে পার হওয়া যাবে না !
অর্থ – যোগ্য ব্যক্তি যেখানে অসফল, অযোগ্য ব্যক্তি সেখানে অকারণে বড়াই করতে এলে ব্যঙ্গ করে এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয়।
৫) খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে
কাল হল তার এঁড়ে গরু কিনে।
চলতি গল্প – একজন তাঁতি তাঁত বুনে বেশ ভালই রোজগার করত । তার ইচ্ছে হওয়ায় হঠাৎ করে সে গরু কিনে চাষির কাজ শুরু করল । কিন্তু চাষের অভিজ্ঞতা না থাকার জন্য তার চাষে লোকসান হল ।
অর্থ – যে মানুষ যা করতে অভ্যস্ত বা অভিজ্ঞ তার সেটাই করা উচিত । অন্যের কথায় বা নিজের খেয়ালে ঝুঁকি নিয়ে অন্য কাজ করতে গেলে লোকসান হতে পারে।
৬) লাভের গুড় পিঁপড়েয় খায়।
চলতি গল্প – এক ব্যক্তি কিছু টাকা রোজগার করে গুড় কিনে আনল। কিন্তু না খেয়ে ঘরে রেখে দেওয়ায় সব গুড় পিঁপড়ে খেয়ে নিল।
অর্থ – নিজের কাজের সুফল অন্যে ভোগ করলে ব্যঙ্গ করে এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয় ।
৭) ঝড়ে বক মরে
ফকিরের কেরামতি বাড়ে।
চলতি গল্প – এক জায়গায় একজন ফকির বক মারার জন্য লোকদেখানো মন্ত্র পড়ছিল । সেই সময় ঝড়ের জন্য একটি বক মারা যায়। কিন্তু লোকে ভাবে ফকিরের কেরামতিতেই বক মারা গেল।
অর্থ – কাকতালীয় ভাবে কোনও মানুষ নিজের না করা কোনও কাজের কৃতিত্ব পেলে এই প্রবাদ ব্যবহার করা হয়।
৮) আপন বোন ভাত পায় না
শালির তরে মণ্ডা।
চলতি গল্প – একজন লোকের বোন খুব গরিব। খেতে পায় না। কিন্তু বোনকে সামান্য ভাত খেতে দিয়ে সাহায্য না করে লোকটা নিজের শালির জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যায়।
অর্থ – নিজের লোককে না দেখে পরের জন্য দরদ দেখালে অথবা যোগ্য ব্যক্তিকে না দিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিকে কিছু দিলে এই প্রবাদ ব্যঙ্গ করে বলা হয়।
৯) অভ্যাস দোষ না ছাড়ে চোরে,
শূন্য ভিটায় মাটি খোঁড়ে
চলতি গল্প – একজন সিঁধেল চোরের এমন স্বভাব যে চুরি না করে সে থাকতে পারে না। চুরি করার সুযোগ না থাকলে ফাঁকা বাড়িতে মাটি খুঁড়তে থাকে।
অর্থ – অভ্যাস মানুষের পিছু ছাড়েনা সে কথাই এখানে বোঝানো হয়েছে। ” চোরের নজর বোঁচকার দিকে ” বা ” স্বভাব যায় না মলে ” একই অর্থে ব্যবহার করা হয়।
১০) ” বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান
এবারে ঘুঘু তোমার আমি বধিব পরান।”
অর্থ – বারবার একই দোষ বা অন্যায় করলেও শেষ পর্যন্ত শাস্তি পেতেই হয়।
বাংলা প্রবচনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য খনার বচন । আনুমানিক অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এগুলো রচনা করা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়। জোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক বিদুষী বাঙালি নারী ছিলেন খনা । তাঁর নামে চলতি ছোট ছোট ছড়াগুলি আজও আমাদের মধ্যে জনপ্রিয়। অভিজ্ঞতা থেকেই এই প্রবচনগুলো তৈরি।
১) আগে খাবে মায়ে
তবে পাবে পোয়ে
অর্থ – জননী পুষ্টি পেলে তবেই সন্তানরা পুষ্টি পায়।
২) ষোলো চাষে মুলা
তার অর্ধেক তুলা
তার অর্ধেক ধান
বিনা চাষে পান
অর্থ – ১৬ দিন চাষ করার পর সেই জমিতে মুলো চাষ করলে ভাল ফলন হয়। তুলো লাগানোর আগে জমিতে ৮ দিন ও ধান লাগানোর আগে ৪ দিন চাষ করলে ভাল ফলন হয়। পানের জমিতে চাষ করার প্রয়োজন হয় না।
৩) কলা রুয়ে না কেটো পাত
তাতেই কাপড়, তাতেই ভাত
অর্থ – কলাগাছের গোড়া কাটতে বারণ করা হচ্ছে। কারণ কলা গাছের নানা জিনিস থেকেই ভাত – কাপড় জুটতে পারে।
৪) জন্ম – মৃত্যু – বিবাহ
তিন জানেন না বরাহ|
অর্থ – জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ কখন কীভাবে হবে তা কেউ বলে দিতে পারে না । বরাহমিহির পুরাকালের একজন সুবিখ্যাত জ্যোতিষী ছিলেন | শোনা যায় খনার শ্বশুর ছিলেন এই বিখ্যাত গণক | মতান্তরে স্বামী ছিলেন বলেও কথিত | অর্থাৎ‚ মানুষের জন্ম‚ মৃত্যু এবং বিয়ে নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে বরাহমিহিরের মতো দক্ষ গণৎকারও ব্যর্থ |
৫) ভরা হতে শূন্য ভাল যদি ভরতে যায়,
আগ
ভদ্রতার বালাই—সাধারণ সৌজন্যবোধ
পৃষ্ঠপ্রদর্শন—–পালানো
দিনে দুপুরে ডাকাতি—–প্রকাশ্য প্রতারণা ও মিথ্যাচার। ডাকাতির মত। দুঃসাহসিক কাজ।
তুলোধুনো হওয়া—–ধুনা তুলোর মতো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়া
মগের মুলুক–(আলংকারিক অর্থ) অরাজক দেশ বা রাজ্য।
আরো পড়ুন: ইংলিশ ভোকাবুলারি যাদের মনে থাকেনা।
ভালো লাগলে পোস্টটি ফেসবুকে শেয়ার করুন।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই ওয়েবসাইটের কোনো কনটেন্ট অন্য কোন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। ইতিমধ্যে থানায় একটি জিডি করা হয়েছে। কেউ এই ওয়েবসাইটের কনটেন্ট কপি করে নিজের নামে চালিয়ে দিলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।