মৃত্যু (“জন্ম, মৃত্যু ও উৎসবে গান”- থেকে)
মৃত্যুর চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত. এর আকস্মিকতা। আমরা যতই প্রস্তুত থাকি না কেন, যেকোন মৃত্যু আমাদের হতচকিয়ে দেবে। এমনকি দীর্ঘদিন রোগে ভুগে যারা মারা যান, তাদের ক্ষেত্রেও এমন একটা আবহের মধ্য দিয়ে বিষয়টা ঘটে যে, আশপাশের লোকেরা বোধ করতে বাধ্য হয়- আহা! এভাবে চলে যাবে, বুঝতে পারি নাই তো!
মৃত্যু এমনই। আমরা কখনোই এর জন্য যথেষ্ট-রকম প্রস্তত থাকতে পারি না। মৃত্যু আমাদেরকে প্রচণ্ডভাবে বিস্মিত করে দেবেই।
দ্বিতীয়ত. মৃত্যু ভীষণ ব্যক্তিগত একটি বিষয়। যে মারা যায় আর তার নিকটজনের বাইরে মৃত্যুর আসলে তেমন কোন প্রভাব নেই। কারো মুত্যুতে আমার কষ্ট পাবো কি পাবো না সেটা ওই ব্যক্তির সাথে আমাদের স্মৃতির উপর নির্ভর করে। যার সাথে আমাদের যত বেশি স্মৃতি, তার মৃত্যুতে আমাদের তত বেশি কষ্ট।
মৃত্যুর কষ্টটা দূরত্বের ওপরও নির্ভর করে। ঘনিষ্ঠ কারো কাছ থেকে বহুদিন দূরে থাকলে, তার মৃত্যুতে শোকের পরিমাণটা কমে আসে। বিষয়টাকে অনেকটা এভাবে বলা যায়- কারো মৃত্যুতে আমরা কতটা শোক অনুভব করবো, সেটা তার সাথে আমাদের স্মৃতির পরিমানের সমানুপাতিক আর দূরত্বের ব্যাস্তানুপাতিক।
তৃতীয়ত. প্রত্যেকটি মৃত্যুর কোন না কোন সুবিধাভোগী থাকে। যেকোন মৃত্যু কারো না কারো জন্য নতুন কোন সুযোগ তৈরি করে। সেটা অণুজীব থেকে শুরু করে কাছের মানুষ- সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
চতুর্থত. আমরা সত্যিকারভাবে কখনোই অন্যকারো মৃত্যুশোক বোধ করতে পারি না। একজন ব্যক্তি তার কাছের কারো মৃত্যুতে যে শোক অনুভব করে তা কখনোই অন্য একজন মানুষ অনুভব করতে পারবে না। আমরা যে বন্ধুবান্ধবকে তাদের প্রিয় কারো মৃত্যুতে সমবেদনা জানাই, সেটা আসলে খুবই অগভীর একটা বিষয়। প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণে বন্ধুটি যে কষ্ট পাচ্ছে সেই কষ্টটা আমাদের পক্ষে সমানভাবে বোধ করা অসম্ভব, আমরা কেবল বন্ধুটির কষ্ট পাবার বিষয়টা অনুভব করতে পারি।
মৃত্যু এমনই অদ্ভুত, ভীষণ বিষন্ন কিন্তু নিত্য একটি বিষয়।
মৃত্যু’র মতো সত্য পৃথিবীতে আর কী আছে? যার জীবন আছে, তাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতেই হবে। জগত টিকে আছে এই জীবন-মৃত্যুর চক্রকে ঘিরেই। জগতের সবকিছুই সীমিত, সেখানে কাউকে অবিনশ্বর করতে গেলে অন্যদের যে জায়গা থাকে না আর! তাতে জগতও অচল হয়ে যাবে। মৃত্যু হচ্ছে জগতকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে চাকা তার জ্বালানি। নতুন কেউ আসবে, আবাসী হবে, ভোগ উপভোগ করবে জগতের রূপ-রস, তারপর একসময় গত হবে, অন্য নতুনকে করে দিতে স্থান।
মৃত্যুর সবচেয়ে গৌরবময় দিকটি হচ্ছে এর আগমনের অনিশ্চয়তা। খুবই বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে- মৃত্যুর মতো অনারাধ্য সত্যটিকে আমরা কেউ-ই নিশ্চয়তায় নিতে পছন্দ করি না। মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই আসবে, সেটা আমরা মেনে নিলেও আমরা কেউ-ই বলতে গেলে জানতে চাই না কখন সে আসবে। অন্য কথায়, মৃত্যুর দিনক্ষণ বিষয়ে অনবহিত থাকাতেই আমাদের প্রাধান্য। আমরা যে কেউ যেকোন সময় মরে যেতে পারি এই সত্যটি আমরা সহজেই মেনে নিয়েছি, কিন্তু কোন নির্দিষ্ট সময়ে আমরা মরে যাবো সেই বিষয়টি আমরা জেনে নিতে চাই না।
এই বিষয়টি সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়, ক্যান্সার বা এই জাতীয় অসুখের সময়। যখন ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়ে রোগীকে বলেন- আপনার আয়ূ আছে আর তিন মাস।
তিনটি মাস বেশ বড় সময় বেঁচে থাকার জন্য। তারপরও এই নিশ্চয়তাটুকু আমাদের ভালো লাগে না। মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা পরের মুহূর্তের অনিশ্চয়তাটুকু মেনে নিতে পারি, কিন্তু তিন মাসের নিশ্চয়তাকে অনারাধ্য জ্ঞান করি।
মৃত্যুর অভিজ্ঞতটা কেমন তা আমরা কেউ-ই জানি না। তবে যারা মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন তাদের বর্ণনায় মৃত্যুকালীন সময় সম্বন্ধে কিছু ধারনা পাওয়া যেতে পার। Near Death Experience (NDE) বা মৃত্যুর সন্নিকটবর্তী অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারা অনেকেই বলেছেন- তাদের মনে হচ্ছিল একটা আলো খুব দ্রুত গতিতে একটা টানেলের মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কারো কারো কাছে মনে হয়েছে সে তার শরীরটিকে উপর থেকে দেখতে পাচ্ছে। বিশেষ করে অপারেশনকালীন অবস্থায় যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয় তারা নিজের শরীরকে ঘিরে ডাক্তারদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছেন, শরীরটাকে কাটাছেড়া করতে দেখেছেন- ইত্যাদি। অনেকেই অত্যন্ত শান্ত, সমহিত একটা অনুভূতি লাভ করেছেন। কেউ কেউ কয়েক মুহূর্তের ভিতর নিজের জীবনটাকে চোখের সামেন চলচ্চিত্রের মতো দেখেছেন। কেউ মনে করেছেন তিনি প্রচন্ড ভালোবাসা বোধ করছেন। কেউ কেউ আবার দেখেছেন নিজেকে প্রবল অন্ধকারে ছুটে যেতে। দেখেছেন একটা সিড়ি বা গলিপথে ধাবিত হতে।
এসব বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায় যে, কার কেমন মৃত্যুকালীন অভিজ্ঞতা হবে সেটা তার সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, পেশা, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। মৃত্যু নিয়ে যারা একটি ইতিবাচক ধারণা রাখেন এবং সে লক্ষ্যে ধর্মীয়, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোন বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাদের শেষটা হয়তো একটা ভালো বোধের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে।
একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- আপনি কী ভূত বিশ্বাস করেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন- আমি ভূত বিশ্বাস করি না, তবে ভূত-কে ভয় করি।
মৃত্যু নিয়ে কাছাকাছি একটি কথা বলা যায়। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি কী মৃত্যুতে ভয় পান? আমার উত্তরটা হবে এ রকম- আমি মৃত্যুকে ভয় করিনা, তবে কীভাবে আমার মৃত্যু হবে সেই ভাবনাটা আমাকে ভীষণ ভীত করে তোলে।
মৃত্যুর চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আছে।
প্রথমত. এর আকস্মিকতা। আমরা যতই প্রস্তুত থাকি না কেন, যেকোন মৃত্যু আমাদের হতচকিয়ে দেবে। এমনকি দীর্ঘদিন রোগে ভুগে যারা মারা যান, তাদের ক্ষেত্রেও এমন একটা আবহের মধ্য দিয়ে বিষয়টা ঘটে যে, আশপাশের লোকেরা বোধ করতে বাধ্য হয়- আহা! এভাবে চলে যাবে, বুঝতে পারি নাই তো!
মৃত্যু এমনই। আমরা কখনোই এর জন্য যথেষ্ট-রকম প্রস্তত থাকতে পারি না। মৃত্যু আমাদেরকে প্রচণ্ডভাবে বিস্মিত করে দেবেই।
দ্বিতীয়ত. মৃত্যু ভীষণ ব্যক্তিগত একটি বিষয়। যে মারা যায় আর তার নিকটজনের বাইরে মৃত্যুর আসলে তেমন কোন প্রভাব নেই। কারো মুত্যুতে আমার কষ্ট পাবো কি পাবো না সেটা ওই ব্যক্তির সাথে আমাদের স্মৃতির উপর নির্ভর করে। যার সাথে আমাদের যত বেশি স্মৃতি, তার মৃত্যুতে আমাদের তত বেশি কষ্ট।
মৃত্যুর কষ্টটা দূরত্বের ওপরও নির্ভর করে। ঘনিষ্ঠ কারো কাছ থেকে বহুদিন দূরে থাকলে, তার মৃত্যুতে শোকের পরিমাণটা কমে আসে। বিষয়টাকে অনেকটা এভাবে বলা যায়- কারো মৃত্যুতে আমরা কতটা শোক অনুভব করবো, সেটা তার সাথে আমাদের স্মৃতির পরিমানের সমানুপাতিক আর দূরত্বের ব্যাস্তানুপাতিক।
তৃতীয়ত. প্রত্যেকটি মৃত্যুর কোন না কোন সুবিধাভোগী থাকে। যেকোন মৃত্যু কারো না কারো জন্য নতুন কোন সুযোগ তৈরি করে। সেটা অণুজীব থেকে শুরু করে কাছের মানুষ- সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
চতুর্থত. আমরা সত্যিকারভাবে কখনোই অন্যকারো মৃত্যুশোক বোধ করতে পারি না। একজন ব্যক্তি তার কাছের কারো মৃত্যুতে যে শোক অনুভব করে তা কখনোই অন্য একজন মানুষ অনুভব করতে পারবে না। আমরা যে বন্ধুবান্ধবকে তাদের প্রিয় কারো মৃত্যুতে সমবেদনা জানাই, সেটা আসলে খুবই অগভীর একটা বিষয়। প্রিয়জনের মৃত্যুর কারণে বন্ধুটি যে কষ্ট পাচ্ছে সেই কষ্টটা আমাদের পক্ষে সমানভাবে বোধ করা অসম্ভব, আমরা কেবল বন্ধুটির কষ্ট পাবার বিষয়টা অনুভব করতে পারি।
মৃত্যু এমনই অদ্ভুত, ভীষণ বিষন্ন কিন্তু নিত্য একটি বিষয়।
মৃত্যু’র মতো সত্য পৃথিবীতে আর কী আছে? যার জীবন আছে, তাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতেই হবে। জগত টিকে আছে এই জীবন-মৃত্যুর চক্রকে ঘিরেই। জগতের সবকিছুই সীমিত, সেখানে কাউকে অবিনশ্বর করতে গেলে অন্যদের যে জায়গা থাকে না আর! তাতে জগতও অচল হয়ে যাবে। মৃত্যু হচ্ছে জগতকে এগিয়ে নিয়ে যাবার যে চাকা তার জ্বালানি। নতুন কেউ আসবে, আবাসী হবে, ভোগ উপভোগ করবে জগতের রূপ-রস, তারপর একসময় গত হবে, অন্য নতুনকে করে দিতে স্থান।
মৃত্যুর সবচেয়ে গৌরবময় দিকটি হচ্ছে এর আগমনের অনিশ্চয়তা। খুবই বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে- মৃত্যুর মতো অনারাধ্য সত্যটিকে আমরা কেউ-ই নিশ্চয়তায় নিতে পছন্দ করি না। মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই আসবে, সেটা আমরা মেনে নিলেও আমরা কেউ-ই বলতে গেলে জানতে চাই না কখন সে আসবে। অন্য কথায়, মৃত্যুর দিনক্ষণ বিষয়ে অনবহিত থাকাতেই আমাদের প্রাধান্য। আমরা যে কেউ যেকোন সময় মরে যেতে পারি এই সত্যটি আমরা সহজেই মেনে নিয়েছি, কিন্তু কোন নির্দিষ্ট সময়ে আমরা মরে যাবো সেই বিষয়টি আমরা জেনে নিতে চাই না।
এই বিষয়টি সবচেয়ে প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়, ক্যান্সার বা এই জাতীয় অসুখের সময়। যখন ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়ে রোগীকে বলেন- আপনার আয়ূ আছে আর তিন মাস।
তিনটি মাস বেশ বড় সময় বেঁচে থাকার জন্য। তারপরও এই নিশ্চয়তাটুকু আমাদের ভালো লাগে না। মৃত্যুর ব্যাপারে আমরা পরের মুহূর্তের অনিশ্চয়তাটুকু মেনে নিতে পারি, কিন্তু তিন মাসের নিশ্চয়তাকে অনারাধ্য জ্ঞান করি।
মৃত্যুর অভিজ্ঞতটা কেমন তা আমরা কেউ-ই জানি না। তবে যারা মৃত্যুর কাছাকাছি অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন তাদের বর্ণনায় মৃত্যুকালীন সময় সম্বন্ধে কিছু ধারনা পাওয়া যেতে পার। Near Death Experience (NDE) বা মৃত্যুর সন্নিকটবর্তী অভিজ্ঞতা যাদের হয়েছে তারা অনেকেই বলেছেন- তাদের মনে হচ্ছিল একটা আলো খুব দ্রুত গতিতে একটা টানেলের মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। কারো কারো কাছে মনে হয়েছে সে তার শরীরটিকে উপর থেকে দেখতে পাচ্ছে। বিশেষ করে অপারেশনকালীন অবস্থায় যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয় তারা নিজের শরীরকে ঘিরে ডাক্তারদের কথাবার্তা শুনতে পেয়েছেন, শরীরটাকে কাটাছেড়া করতে দেখেছেন- ইত্যাদি। অনেকেই অত্যন্ত শান্ত, সমহিত একটা অনুভূতি লাভ করেছেন। কেউ কেউ কয়েক মুহূর্তের ভিতর নিজের জীবনটাকে চোখের সামেন চলচ্চিত্রের মতো দেখেছেন। কেউ মনে করেছেন তিনি প্রচন্ড ভালোবাসা বোধ করছেন। কেউ কেউ আবার দেখেছেন নিজেকে প্রবল অন্ধকারে ছুটে যেতে। দেখেছেন একটা সিড়ি বা গলিপথে ধাবিত হতে।
এসব বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায় যে, কার কেমন মৃত্যুকালীন অভিজ্ঞতা হবে সেটা তার সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস, পেশা, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা, সামাজিক ও পারিবারিক জীবন ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। মৃত্যু নিয়ে যারা একটি ইতিবাচক ধারণা রাখেন এবং সে লক্ষ্যে ধর্মীয়, সামাজিক বা ব্যক্তিগত কোন বিশ্বাস স্থাপন করেন, তাদের শেষটা হয়তো একটা ভালো বোধের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে।
একজন বিখ্যাত অভিনেত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- আপনি কী ভূত বিশ্বাস করেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন- আমি ভূত বিশ্বাস করি না, তবে ভূত-কে ভয় করি।
মৃত্যু নিয়ে কাছাকাছি একটি কথা বলা যায়। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি কী মৃত্যুতে ভয় পান? আমার উত্তরটা হবে এ রকম- আমি মৃত্যুকে ভয় করিনা, তবে কীভাবে আমার মৃত্যু হবে সেই ভাবনাটা আমাকে ভীষণ ভীত করে তোলে।
Mustak Ibn Ayub